সাধারণত আমাদের হাত ও পায়ের নখ মসৃণ হয়। স্বাভাবিক নখে কোনো দাগ অথবা গর্ত থাকে না। সুস্থ নখ দেখতে হালকা গোলাপি রঙের হয়ে থাকে।
নখে হঠাৎ কোনো পরিবর্তন আসলে সেটি কোনো সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। তাই কোন ধরনের পরিবর্তন কী নির্দেশ করতে পারে তা জানা প্রয়োজন। এতে করে কিছু জটিল রোগ প্রাথমিক পর্যায়েই শনাক্ত করা সম্ভব হবে। জটিল রোগ না হয়ে থাকলে সেটিও নিশ্চিত হয়ে নেওয়া যাবে।
নখের কিছু কমন সমস্যা ও সেটি কেন হতে পারে তা এখানে আলোচনা করা হয়েছে।
পায়ের নখ মরে গেলে করনীয়,পায়ের আঙ্গুলের নখের সমস্যা
১. নখকুনি
যদি কখনো নখের কোণা বাইরের দিকে বড় না হয়ে ত্বকের ভেতরের দিকে বাড়তে থাকে, তখন তাকে নখকুনি বলে। সাধারণত পায়ের বুড়ো আঙুল এই সমস্যায় আক্রান্ত হয়। নখের স্বাভাবিক গঠন যদি বাঁকা অথবা ফ্যানের মত হয় তাহলে এমনটা হতে পারে। এ ছাড়াও এমন হতে পারে যদি—
- আঁটসাঁট জুতা কিংবা মোজা পরা হয়
- পা বেশি ঘামে
- ভুল নিয়মে নখ কাটলে
- নখে কোনো আঘাত পেলে
নখের এই বাড়তি অংশ ত্বক ভেদ করে ভেতরে গেলে আশেপাশের ত্বকসহ নখে প্রচুর ব্যথা হয়। এ ছাড়াও নিচের সমস্যাগুলো হতে পারে—
- লাল হয়ে যায়
- পুঁজ অথবা তরল পদার্থ জমে ফুলে যায়, জ্বর আসে অথবা শরীরে কাঁপুনি হয়
- রক্তপাত হয়
- সাদা অথবা হলুদ রঙের পুঁজ বের হয়ে আসে
- নখের চারপাশের মাংস ফুলে যায়
এসব অবস্থা সৃষ্টি হলে দ্রুত ডাক্তার দেখাতে হবে। পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে যেন নখের ইনফেকশন না হয়। এজন্য—
- নখ শুকনো রাখতে হবে
- প্রয়োজনে হালকা কুসুম লবণ পানিতে কিছুক্ষণ পা ভিজিয়ে রাখা যায়
- ঢিলেঢালা ও আরামদায়ক জুতা পরতে হবে
- ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল ও আইবুপ্রোফেন খাওয়া যেতে পারে
- নিজে নখ খোঁচাখুঁচি বা কাটার চেষ্টা করা যাবে না
এর পরেও যদি ব্যথা না কমে অথবা পুঁজ বের হয়ে আসে তাহলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। রোগীর ডায়াবেটিস থাকলে কিংবা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসলে ঘরে বসে দেরি না করে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
২. ফ্যাকাশে নখ
সাধারণত নখের রং হালকা গোলাপি থাকে। কিন্তু নখ ফ্যাকাশে সাদা হয়ে গেলে তা রক্তশূন্যতাজনিত কারণে হয়ে থাকে। অপুষ্টি ও লিভারের রোগের জন্য এমন হতে পারে।
তাই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। সঠিক কারণ খুঁজে তার চিকিৎসা করলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
অনেক সময় আমরা সুষম খাবার না খাওয়ার কারণে অপুষ্টিতে ভুগি। বিশেষ করে ওজন কমানোর জন্য বিশেষ ডায়েট অনুসরণ করতে গেলে এমন হতে পারে।
৩. দাঁত দিয়ে নখ কামড়ানো
ছোটো শিশুরা সাধারণত দাঁত দিয়ে নখ চাবায়। বড় হলে এই অভ্যাস চলে যায়। কিন্তু বড় হওয়ার পরেও এই অভ্যাস থাকলে তা সমস্যার কারণ।
মানসিক চাপে থাকলে কিংবা কোনো মানসিক রোগে ভুগলে (যেমন: অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার বা ওসিডি রোগে) এমন অভ্যাস থাকতে পারে।
অনেক চেষ্টা করার পরেও এই অভ্যাস নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এভাবে রোগী কোনো মানসিক রোগে ভুগছে কি না সেটি বের করে, প্রয়োজনবোধে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যাবে।
৪. নখে ছোটো ছোটো গর্ত
সোরিয়াসিস রোগের কারণে নখে ছোটো ছোটো গর্ত হয়ে যায়। গর্তগুলো দেখলে মনে হবে যেন শক্ত কোনো কিছু দিয়ে নখ খোঁচানো হয়েছে। একজিমা নামক একধরনের চর্মরোগ অথবা এলোপেসিয়া নামক চুল পড়ে যাওয়ার রোগ থেকেও এমন পরিবর্তন আসতে পারে।
এমনটা হলে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। তিনি সঠিকভাবে রোগনির্ণয় করে উপযুক্ত চিকিৎসা দিতে পারবেন।
৫. নখ হলুদ হয়ে যাওয়া
সাধারণত নখে ফাঙ্গাল ইনফেকশন বা ছত্রাকের আক্রমণে নখের রং হলুদ হয়ে যায়। প্রথমে নখের কোণা হলুদ হওয়া শুরু করে। এরপর ধীরে ধীরে পুরো নখ হলুদ হতে থাকে। একসময় নখ দুর্বল হয়ে কোণা থেকে ভেঙে যাওয়া শুরু হয়। সঠিক চিকিৎসা ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
উল্লেখ্য, নখে ফাঙ্গাল ইনফেকশন হলে সাধারণত দীর্ঘদিন ধরে ঔষধ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়। নখের ইনফেকশন সারাতে ও সমস্যা পুনরায় ফিরে আসা ঠেকাতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধের কোর্স সম্পন্ন করা গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি ইনফেকশন প্রতিরোধে নখের সঠিক যত্ন নেওয়াও জরুরি।
ফাঙ্গাল ইনফেকশনের পাশাপাশি ফুসফুসের রোগ, ডায়াবেটিস ও সোরিয়াসিস নামক চর্মরোগেও নখের রং হলুদ হয়ে যেতে পারে।
কিছু সাধারণ কারণেও নখ হলুদ হয়ে যায়। যেমন: হলুদ দেয়া খাবার হাত দিয়ে খেলে এবং বেশি ধূমপান করলে। এসব ক্ষেত্রে কারণগুলো এড়িয়ে চললে যদি নখ স্বাভাবিক হয়ে যায়, তখন আর ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
৬. নখের আশেপাশের মাংস লাল হয়ে ফুলে যাওয়া
নখের আশেপাশের চামড়ায় ইনফেকশন হলে এমনটা হতে পারে। যারা ঘন ঘন সাবান-পানির কাজ করেন, তাদের ক্ষেত্রে এটি বেশি দেখা যায়।
এ ছাড়া কানেক্টিভ টিস্যুর রোগ হলেও এ ধরনের সমস্যা দেখা যায়। কানেক্টিভ টিস্যুর কাজ হলো শরীরের বিভিন্ন অংশগুলোকে একে অপরের সাথে জোড়া লাগিয়ে রাখতে সাহায্য করা। নখের আশেপাশের মাংস ফুলে যাওয়ার সাথে অন্য কোনো লক্ষণ থাকলে (যেমন: সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কষ্ট হলে) তা কানেক্টিভ টিস্যুর রোগ হতে পারে। এমন কিছু হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
অতিরিক্ত ডিটারজেন্ট কিংবা সাবান ব্যবহার করলে অথবা থালাবাসন ও কাপড় ধোয়ার কাজ করলে নখ ক্ষয় হয়ে ভেঙে যায়। যদি পানির কাজ করা বন্ধ করে দিলে নখের সমস্যা ভালো হয়ে যায় তাহলে এসব ক্ষেত্রে ডাক্তারের কাছে না গেলেও হয়।
তবে দীর্ঘদিন এ ধরনের সমস্যায় ভুগলে এবং ডিটারজেন্ট ও পানির ব্যবহার না কমালে আস্তে আস্তে নখে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে। সাথে সাথে নখের আশেপাশের ত্বক ফুলে ও লাল হয়ে যেতে পারে। তখন পানি ব্যবহার কমালেও আপনা-আপনি নখ ভালো হয়ে যায় না। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
ভঙ্গুর নখ ও নখের ইনফেকশন প্রতিরোধে ঘন ঘন অথবা দীর্ঘ সময় ধরে পানি ও সাবানের সংস্পর্শে হাত রাখা এড়িয়ে চলতে হবে। সম্ভব হলে ধোয়ার কাজ কমিয়ে দিন। প্রয়োজনে কাজ করার সময়ে হাতে রাবারের গ্লাভস্ পরতে পারেন। পানির কাজ শেষে হাতে ও নখে লোশন মাখিয়ে নিন।
৭. নখের মাথা সামনে থেকে ভেঙে যাওয়া
আঘাত পেলে নখ ভেঙে যেতে পারে। তবে থাইরয়েডের রোগ অথবা রক্তশূন্যতার কারণে কোনো প্রকার আঘাত ছাড়াই নখ ভেঙে যায়। আবার নখ ভাঙার সাথে যদি নখ হলুদ হয়ে যায় তাহলে সেটি ফাঙ্গাস বা ছত্রাকের আক্রমণ থেকে হতে পারে। তাই ডাক্তারের কাছে যেয়ে সঠিক কারণ নির্ণয় করা জরুরি। সাধারণ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই এসব কারণ শনাক্ত করা যায়।
ছোটোখাটো আঘাতে নখ অল্প একটু ভাঙলে এবং সাথে অন্য কোনো লক্ষণ না থাকলে তা আপনা-আপনি সেরে যায়। তবে আঘাত বড় হলে এবং অন্য কোনো লক্ষণ (যেমন: ব্যথা, ফুলে যাওয়া, লাল হয়ে যাওয়া ও রক্তপাত) দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
এ ছাড়াও নখের যত্ন নেয়ার পরেও নখ সবসময় ভঙ্গুর হয়ে থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
৮. নখ সবুজ হয়ে যাওয়া
নখে একধরনের ব্যাকটেরিয়া দিয়ে ইনফেকশন হলে এমন হয়। সঠিক চিকিৎসা ছাড়া এই সমস্যা আপনা-আপনি ভালো হয় না। তাই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
৯. নখ মাঝখানে দেবে যাওয়া
কিছু রোগে নখ মাঝখানে দেবে যায়। যেমন: আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা। তখন নখ দেখতে অনেকটা চা-চামচের মতো লাগে।
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রনের অভাব পূরণ করলেই এই সমস্যা সাধারণত ঠিক হয়ে যায়।
১০. নখে লম্বা গাঢ় দাগ থাকলে
নখে কোনো আঘাত লাগলে এমন দাগ হতে পারে। আঘাতের কারণে নখে গাঢ় কোনো দাগ হলে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আঘাত ভালো হয়ে গেলে এবং নখ বড় হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে দাগ আপনা-আপনি চলে যায়।
তবে এক ধরনের চামড়ার ক্যান্সার বা স্কিন ক্যান্সারেও এমন দাগ দেখা যায়। কোনো আঘাত ছাড়াই নখে এমন কোনো দাগ বেশ কিছুদিন ধরে থাকলে, অথবা আগের এমন দাগ আরও ছড়িয়ে গেলে কিংবা রং বদলালে—তা জটিল রোগ থেকে হতে পারে। এমন কিছু হলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
১১. নখ নীল হয়ে গেলে
কখনো কখনো রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ অনেক কমে গেলে নখ হঠাৎ করে নীল হয়ে যায়। পাশাপাশি বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট থাকতে পারে। এগুলো মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতার লক্ষণ। তাই এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
এখানে উল্লেখকৃত সমস্যাগুলো হলে অবহেলা না করে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তা ছাড়া আপনি যদি বুঝতে না পারেন কেন নখে পরিবর্তন হলো, অথবা অন্য কোনো কারণে যদি নখ নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়, তাহলেও একজন ডাক্তার দেখিয়ে নিন।
আর যদি কোনো সাধারণ কারণে নখের পরিবর্তন হয়ে থাকে তাহলে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কিছু অভ্যাস পরিবর্তন করে, পুষ্টিকর খাবার খেলে এবং নিয়ম মেনে নখের যত্ন নিলেই নখ সুস্থ-স্বাভাবিক রাখা সম্ভব।
পরিশেষে : পায়ের নখ পচে যাওয়া,পায়ের নখ মরে যায় কেন
আপনার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ক আরো কিছু পোস্ট